কে জিতবেন বলতে পারেন? না, অনিশ্চয়তা আকাশচুম্বী
- আপডেট সময় : ১০:৩৯:১৭ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৪ ১১ বার পঠিত
মার্কিন ভোটাররা সাধারণত নির্বাচনের মাস মার্কিন ভোটাররা থাকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করেন। এ কারণে নির্বাচনের শেষ মাসটিই ভোটারদের কাছে হয়ে ওঠে অর্থবহ। বিগত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনগুলোতে সচরাচর এমনটাই দেখা যায়। ফলে নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল সম্পর্কে আগে থেকে নিশ্চিত করে কিছু বলা বেশ মুশকিল।
নির্বাচনের আর মাত্র কয়েকটা দিন বাকি আছে। তবে ইতিমধ্যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের গায়ে লেগে গেছে ‘স্বৈরাচার’, ‘বর্ণবাদী’ প্রভৃতি তকমা । তিনিও কম যান না! শত্রুদের কয়েদখানায় পাঠানোর হুংকার দিয়ে রেখেছেন এই সাবেক প্রেসিডেন্ট। এমনকি অভিবাসীদের ‘নরখাদক’ হিসেবে অভিহিত করে বহু কথা বলেছেন। তবে এত কিছুর পরও জাতি তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, এমন কথা বলা যাচ্ছে না। কারণ, প্রায় সব জাতীয় পোলে জনপ্রিয় ভোটে (পপুলার ভোট) ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে কমলা হ্যারিস কিছুটা এগিয়ে থাকলেও দুজনের মধ্যকার ব্যবধান খুব একটা বেশি নয়।
ঠিক এমন একটি প্রেক্ষাপটে আগামী ৫ নভেম্বর অনুষ্ঠিতব্য এই নির্বাচনের বিষয়ে আপাতত নিম্নলিখিত বিষয়গুলোর প্রতি আমাদের নজর দেওয়া দরকার।
প্রথমেই দৃষ্টি দিতে হবে সুইং স্টেটগুলোর (দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্য) দিকে । লক্ষ করার বিষয়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট সরাসরি নির্বাচিত হন না, বরং তিনি বিজয়ী হন ইলেকটোরাল কলেজের ভোটে। হ্যারিস যে জনপ্রিয় ভোটে জিতবেন, অবস্থাদৃষ্টে সেটাই মনে করছেন অনেকে। তবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে হলে তাকে ইলেকটোরাল কলেজের ভোটেও জিততে হবে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০১৬ সালে জনপ্রিয় ভোটে হারলেও ইলেকটোরাল কলেজ ভোটে বিজয়ী হয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন ট্রাম্প। সেবারকার মতো তিনি আবারও জয়ী হলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। আর এক্ষেত্রে বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারে তথাকথিত ‘সুইং স্টেটস’। অর্থাৎ, আমাদের আপাতত সুইং স্টেটসের দিকে ফোকাস রাখতে হবে। এবারকার নির্বাচনে এ ধরনের সাতটি সুইং স্টেটস হলো অ্যারিজোনা, জর্জিয়া, মিশিগান, নেভাদা, উত্তর ক্যারোলিনা, পেনসিলভানিয়া ও উইসকনসিন ।
দ্বিতীয়ত, আমাদের লক্ষ রাখতে হবে ইলেকটোরাল কোয়ালিশন তথা নির্বাচনী জোটের প্রতি। ট্রাম্পের অনেকগুলো সমজাতীয় নির্বাচনী জোট রয়েছে, যাদের বেশির ভাগই ধৰ্মীয় শ্বেতাঙ্গ ভোটার। মূলত বিগত কয়েক দশক ধরে ধর্মপ্রচারকদের পাশাপাশি পুরুষ (মেল) ও সাদা ভোটারদের দলের প্রতি আকৃষ্ট করার কাজ করে গেছে রিপাবলিকান পার্টি। যদিও এই সংখ্যা খুব বেশি নয়। অধিকন্তু, পোল ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, হিস্পানিক ও কিছুসংখ্যক আফ্রিকান-আমেরিকান পুরুষ ভোটারও ট্রাম্পের পক্ষে যোগ দিয়েছেন। তবে রিপাবলিকান পার্টির জন্য প্রধান উদ্বেগ হয়ে উঠেছেন বিশেষত তরুণ শ্বেতাঙ্গ ভোটাররা। শ্বেতাঙ্গ নারীরা একসময় ট্রাম্পের সমর্থক ছিলেন। তবে গর্ভপাত ইস্যুকে কেন্দ্র করে বিশেষত ২০১৬ সালে জনপ্রিয় ভোটে হারলেও ইলেকটোরাল কলেজ ভোটে বিজয়ী হয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন ট্রাম্প। সেবারকার মতো তিনি আবারও জয়ী হলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না। আর এক্ষেত্রে বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারে তথাকথিত ‘সুইং স্টেটস’ অল্পবয়স্ক নারীরা কট্টর ট্রাম্প-বিরোধী হয়ে উঠেছেন। এই বিষয়টি রিপাবলিকান শিবিরকে বেশ ভোগাতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিশেষ করে, যদি তরুণ শ্বেতাঙ্গ নারীরা বিপুল সংখ্যায় ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ভোট দেন, তাহলে হ্যারিসের প্রতি জয়ের পাল্লা ভারী হয়ে উঠবে। ডেমোক্র্যাটরা ঐতিহ্যগতভাবেই আফ্রিকান- আমেরিকান ও হিস্পানিক ভোটারদের পাশাপাশি বিপুলসংখ্যক শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের সমর্থন পেয়ে থাকে। জো বাইডেনের ‘অলস প্রচারণা’ মাঝে কিছুদিন এই প্রবণতায় ভাটা এনেছিল বটে, কিন্তু কমলা হ্যারিসের নিরলস প্রচেষ্টায় ডেমোক্র্যাটদের প্রতি আবারও শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের উৎসাহ ফিরে এসেছে।
তবে হ্যারিসের জন্য দুঃসংবাদ হলো, হিস্পানিক ভোটাররা বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে রিপাবলিকান পার্টির দিকে ঝুঁকছে। এমনকি আফ্রিকান-আমেরিকান পুরুষ ভোটারদের একটি অংশ প্রেসিডেন্ট হিসেবে একজন নারীকে ভোট দিতে অনিচ্ছুক বলে মনে করা হচ্ছে। এসবের পাশাপাশি রয়েছে গাজা ইস্যু, যার পটভূমিতে অনেক আরব-আমেরিকান এবং মুসলিম-আমেরিকান ভোটার ট্রাম্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। সেই সঙ্গে বলতে হয়, প্রগতিশীল শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের কথাও। এই ভোটারদের একটি বড় অংশ ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিয়েছে। অর্থাৎ, এই ভোটাররা হ্যারিস ও ট্রাম্পের মধ্যে কাকে ভোট দেবেন, সেই প্রশ্নের চেয়ে বরং বড় বিষয় হয়ে উঠেছে—তারা হ্যারিসকে ভোট দেবেন নাকি তাকে আদৌ ভোট দেবেন না ।
তৃতীয়ত, আমাদের মনে রাখতে হবে, নির্বাচনের দিনই চূড়ান্ত দিন নয়। অনেকে হয়তো মনে করছেন, নির্বাচনের দিনই সব কিছু জানা যাবে। এক্ষেত্রে বলতে হয়, চূড়ান্ত বিজয়ী কে—এই প্রশ্নের জবাব ৫ নভেম্বরই পাওয়া যাবে না। গত নির্বাচনে চূড়ান্ত ফলাফল হাতে আসতে চার দিন সময় লেগেছিল। এবার সম্ভবত আরও বেশি সময় লাগতে পারে। এর কারণ, রিপাবলিকানরা আস্তে-ধীরে ভোট গণনা করার অনেকগুলো ব্যবস্থা চালু করেছে (যেমন হাতে গণনা)।
সমস্যা আছে আরেক জায়গায়। সব ভোট গণনা হয়ে যাওয়ার পরও বাধতে পারে বিপত্তি! বিশেষ করে, ট্রাম্প বিজয়ী না হলে আমরা বেশ কিছু ‘প্রাতিষ্ঠানিক চ্যালেঞ্জ’ প্রত্যক্ষ করতে পারি। ২০২০ সালের নির্বাচনের পর ঠিক এমন চিত্রই দেখা গিয়েছিল। তবে সেবারকার ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর রিপাবলিকানরা জর্জিয়ার মতো কিছু সুইং স্টেটসহ নির্বাচনী বোর্ড এবং রাজ্য আদালতের মতো জায়গায় নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করেছেন।
যাহোক, নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যে শঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন যে, ভোট গণনায় বিলম্ব হওয়াটা স্বাভাবিক, কিন্তু বেশি বিলম্ব হলে তাতে করে বিশৃঙ্খলার ঘটনাও ঘটবে । অর্থাৎ, আমাদের মাথায় রাখতে হবে নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার বিষয়টিও। সব ভোট গণনা শেষে চূড়ান্ত ফলাফল প্রত্যয়িত হওয়ার পরও যদি বিশেষ করে ট্রাম্প নির্বাচনে হেরে যান, তাহলে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। নির্বাচনে হেরে ক্যাপিটল হিলে ট্রাম্প সমর্থকরা কী ধরনের অরাজকতা সৃষ্টি করেছিল, তা মনে আছে সবার। ট্রাম্প ও তার ভাইস-প্রেসিডেন্ট প্রার্থী জেডি ভ্যান্স এখনো বাইডেনের নির্বাচনকে স্বীকৃতি দেননি, তার বিজয়কে স্বীকার করেননি। এমনকি ৫৭ শতাংশ রিপাবলিকান বিশ্বাস করেন যে, নির্বাচনে বাইডেন অবৈধভাবে বিজয় লাভ করেছিলেন। এর চেয়েও সাংঘাতিক কথা, ট্রাম্প ও ভ্যান্স উভয়ই ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন যে, এই নির্বাচনে তারা কোনোভাবে পরাজিত হলে তা মানবেন না।
আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, এবারের নির্বাচন ঘিরে ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকান উভয় দলের মধ্যে ‘নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা’ নিয়ে দেশব্যাপী উদ্বেগ ক্রমশ বাড়ছে। জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক মনে করে যে, নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার ঘটনা ঘটলে এমনকি দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হতে পারে!
বস্তুত, ষড়যন্ত্র তত্ত্ব এবং বিপুলসংখ্যক আধা-স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের বিস্তার নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার আশঙ্কাকে বহু গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আমার ধারণা, গৃহযুদ্ধ শুরু না হলেও আমরা হয়তো-বা আরেকটি বড় বিদ্রোহ দেখতে পাব । কোনো সন্দেহ নেই, আমরা চরম উত্তেজনার মধ্যে আছি এবং ৫ নভেম্বরের পর তা আরো প্রকট ও দীর্ঘস্থায়ী হবে।