ঢাকা ০১:৪১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৬ জানুয়ারী ২০২৫, ১২ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

যে সকল দেশ জাতীয় সংগীতের পরিবর্তন এ‌নে‌ছে

এখনই সময় ডেস্ক :
  • আপডেট সময় : ০৯:০৩:১২ অপরাহ্ন, বুধবার, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ৬১ বার পঠিত

সৈয়দ আতিকুর রব

জাতীয় সঙ্গীত একটি জাতির পরিচয়, চেতনা এবং সংস্কৃতির প্রতীক। এটি একটি দেশের সংগ্রাম, ঐতিহ্য, এবং ভবিষ্যতের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত “আমার সোনার বাংলা” একটি সুপ্রাচীন গান, যা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করেছেন। এটি বাংলার প্রতি অগাধ ভালোবাসা এবং মাতৃভূমির প্রতি শ্রদ্ধার প্রতীক হলেও, দেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ পর্বগুলোর প্রতিফলন নেই। এমন প্রেক্ষাপটে জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের বিষয়টি নতুন করে আলোচনার দাবি রাখে। ব্যক্তি/দলের উর্ধে উঠে এর গঠনমুলক আলোচনা হওয়া দরকার।

ইতিহাসের আলোকে বিশ্লেষণ:

১. বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপট: “আমার সোনার বাংলা” ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময়ে রচিত হয়েছিল। এই গানের মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা করা এবং বাংলা অঞ্চলের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করা। এটি তখনকার বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ করতে সহায়ক ছিল, কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রেক্ষাপটে এটি রচিত হয়নি। এই গানটির রচনার সময় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সত্তা বা অস্তিত্বের কোনো প্রসঙ্গ ছিল না।

২. ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন:

বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। এই আন্দোলন বাংলাদেশের জাতীয় চেতনার ভিত্তি স্থাপন করেছে, এবং বাঙালি জাতির সত্তাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। তবে, “আমার সোনার বাংলা”তে এই আন্দোলনের কোনো উল্লেখ নেই। একটি জাতীয় সঙ্গীতে এমন একটি গৌরবময় অধ্যায়কে তুলে ধরার প্রয়োজন রয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্মের পটভূমি গড়ে তুলেছিল।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছি। কিন্তু “আমার সোনার বাংলা” গানে এ ঐতিহাসিক বিজয়ের কোনো প্রতিফলন নেই। একটি জাতীয় সঙ্গীতের মূল অংশ হওয়া উচিত এই জাতীয় বীরত্বের ইতিহাস এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে সম্মান জানানো।

অন্য দেশের উদাহরণ:

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন করেছে সময়ের আলোকে , যেটি তাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং সমসাময়িক বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। যেমন: অস্ট্রেলিয়া: ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি তাদের জাতীয় সঙ্গীত “Advance Australia Fair” এর একটি লাইন পরিবর্তন করে। আগের লাইনটি ছিল “For we are young and free,” যা পরিবর্তন করে “For we are one and free” করা হয়। এই পরিবর্তনের মাধ্যমে দেশটির আদিবাসী জনগোষ্ঠীর দীর্ঘ ইতিহাসকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, এবং এটি জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে উদযাপিত হয়েছে।

জার্মানি: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি তাদের জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন করে, যাতে তারা আগের রাজনৈতিক বিতর্ক এবং নেতিবাচক ইতিহাস থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে নাৎসি শাসনের পতনের পর, জার্মানি তাদের জাতীয় সঙ্গীত “Deutschlandlied” এর প্রথম দুটি স্তবক বাদ দেয়। এই স্তবকগুলোতে “Deutschland, Deutschland über alles” (জার্মানি সবার উপরে) বাক্যাংশটি ছিল, যা নাৎসি শাসনের সাথে সম্পর্কিত এবং জাতীয়তাবাদী উগ্রতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। পরিবর্তে, তারা তৃতীয় স্তবকটি ব্যবহার শুরু করে, যা “Einigkeit und Recht und Freiheit” (একতা, ন্যায়বিচার এবং স্বাধীনতা) নিয়ে রচিত। এটি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে এবং জার্মানির নতুন দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিফলিত করে।

দক্ষিণ আফ্রিকা: দক্ষিণ আফ্রিকা ১৯৯৭ সালে তাদের জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন করে। নতুন সঙ্গীতটি পাঁচটি ভাষায় লেখা এবং এটি দুটি পুরানো সঙ্গীতকে একত্রিত করে তৈরি করা হয়েছে—”Nkosi Sikelel’ iAfrika” (আফ্রিকার জন্য প্রার্থনা) এবং “Die Stem van Suid-Afrika” (দক্ষিণ আফ্রিকার কণ্ঠস্বর)। এটি দক্ষিণ আফ্রিকার বহু সংস্কৃতির মিশ্রণ এবং আপারথেইডের পর জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রতীক।

রাশিয়া: সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর, রাশিয়া তাদের জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন করেছিল। ২০০০ সালে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সোভিয়েত সঙ্গীতের সুর পুনর্বহাল করেন, কিন্তু নতুন শব্দ যোগ করা হয়, যা বর্তমান রাশিয়ার মূল্যবোধ এবং ঐতিহ্যকে প্রতিফলিত করে।

আমরা যদি আমাদের জাতীয় সঙ্গীতে দেশের গৌরবময় ইতিহাস এবং সংগ্রামের প্রতিফলন চাই, তবে এর পরিবর্তন বা সম্পূরক একটি জাতীয় সঙ্গীতের প্রবর্তন প্রয়োজন। এতে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, এবং স্বাধীনতার গৌরবময় ইতিহাস স্থান পাবে। এটি আমাদের নতুন প্রজন্মকে তাদের ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের সুযোগ করে দেবে এবং জাতীয় চেতনা আরও সুদৃঢ় করবে। “আমার সোনার বাংলা” আমাদের জাতীয় চেতনার একটি অমূল্য অংশ, তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে এর প্রয়োজনীয়তা পুনর্বিবেচনা করার সময় এসেছে। ইতিহাসের গভীর বিশ্লেষণের ভিত্তিতে, আমাদের জাতীয় সঙ্গীতে দেশের সংগ্রাম, ভাষা, সংস্কৃতি এবং স্বাধীনতার প্রতিফলন থাকা জরুরি। জাতীয় সঙ্গীতের পরিবর্তন একটি সাহসী পদক্ষেপ হলেও, এটি একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হতে পারে, যা আমাদের জাতির পরিচয়কে আরও শক্তিশালী করে তুলবে।

লেখক: সৈয়দ আতিকুর রব, আয়ারল্যান্ড প্রবাসী।

ট্যাগস :

যে সকল দেশ জাতীয় সংগীতের পরিবর্তন এ‌নে‌ছে

আপডেট সময় : ০৯:০৩:১২ অপরাহ্ন, বুধবার, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

সৈয়দ আতিকুর রব

জাতীয় সঙ্গীত একটি জাতির পরিচয়, চেতনা এবং সংস্কৃতির প্রতীক। এটি একটি দেশের সংগ্রাম, ঐতিহ্য, এবং ভবিষ্যতের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে। বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত “আমার সোনার বাংলা” একটি সুপ্রাচীন গান, যা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা করেছেন। এটি বাংলার প্রতি অগাধ ভালোবাসা এবং মাতৃভূমির প্রতি শ্রদ্ধার প্রতীক হলেও, দেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ পর্বগুলোর প্রতিফলন নেই। এমন প্রেক্ষাপটে জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তনের বিষয়টি নতুন করে আলোচনার দাবি রাখে। ব্যক্তি/দলের উর্ধে উঠে এর গঠনমুলক আলোচনা হওয়া দরকার।

ইতিহাসের আলোকে বিশ্লেষণ:

১. বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপট: “আমার সোনার বাংলা” ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময়ে রচিত হয়েছিল। এই গানের মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরোধিতা করা এবং বাংলা অঞ্চলের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করা। এটি তখনকার বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ করতে সহায়ক ছিল, কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রেক্ষাপটে এটি রচিত হয়নি। এই গানটির রচনার সময় বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সত্তা বা অস্তিত্বের কোনো প্রসঙ্গ ছিল না।

২. ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন:

বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। এই আন্দোলন বাংলাদেশের জাতীয় চেতনার ভিত্তি স্থাপন করেছে, এবং বাঙালি জাতির সত্তাকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। তবে, “আমার সোনার বাংলা”তে এই আন্দোলনের কোনো উল্লেখ নেই। একটি জাতীয় সঙ্গীতে এমন একটি গৌরবময় অধ্যায়কে তুলে ধরার প্রয়োজন রয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্মের পটভূমি গড়ে তুলেছিল।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছি। কিন্তু “আমার সোনার বাংলা” গানে এ ঐতিহাসিক বিজয়ের কোনো প্রতিফলন নেই। একটি জাতীয় সঙ্গীতের মূল অংশ হওয়া উচিত এই জাতীয় বীরত্বের ইতিহাস এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে সম্মান জানানো।

অন্য দেশের উদাহরণ:

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন করেছে সময়ের আলোকে , যেটি তাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং সমসাময়িক বাস্তবতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। যেমন: অস্ট্রেলিয়া: ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি তাদের জাতীয় সঙ্গীত “Advance Australia Fair” এর একটি লাইন পরিবর্তন করে। আগের লাইনটি ছিল “For we are young and free,” যা পরিবর্তন করে “For we are one and free” করা হয়। এই পরিবর্তনের মাধ্যমে দেশটির আদিবাসী জনগোষ্ঠীর দীর্ঘ ইতিহাসকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, এবং এটি জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে উদযাপিত হয়েছে।

জার্মানি: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি তাদের জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন করে, যাতে তারা আগের রাজনৈতিক বিতর্ক এবং নেতিবাচক ইতিহাস থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে নাৎসি শাসনের পতনের পর, জার্মানি তাদের জাতীয় সঙ্গীত “Deutschlandlied” এর প্রথম দুটি স্তবক বাদ দেয়। এই স্তবকগুলোতে “Deutschland, Deutschland über alles” (জার্মানি সবার উপরে) বাক্যাংশটি ছিল, যা নাৎসি শাসনের সাথে সম্পর্কিত এবং জাতীয়তাবাদী উগ্রতার প্রতীক হয়ে উঠেছিল। পরিবর্তে, তারা তৃতীয় স্তবকটি ব্যবহার শুরু করে, যা “Einigkeit und Recht und Freiheit” (একতা, ন্যায়বিচার এবং স্বাধীনতা) নিয়ে রচিত। এটি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে এবং জার্মানির নতুন দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিফলিত করে।

দক্ষিণ আফ্রিকা: দক্ষিণ আফ্রিকা ১৯৯৭ সালে তাদের জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন করে। নতুন সঙ্গীতটি পাঁচটি ভাষায় লেখা এবং এটি দুটি পুরানো সঙ্গীতকে একত্রিত করে তৈরি করা হয়েছে—”Nkosi Sikelel’ iAfrika” (আফ্রিকার জন্য প্রার্থনা) এবং “Die Stem van Suid-Afrika” (দক্ষিণ আফ্রিকার কণ্ঠস্বর)। এটি দক্ষিণ আফ্রিকার বহু সংস্কৃতির মিশ্রণ এবং আপারথেইডের পর জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রতীক।

রাশিয়া: সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর, রাশিয়া তাদের জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন করেছিল। ২০০০ সালে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সোভিয়েত সঙ্গীতের সুর পুনর্বহাল করেন, কিন্তু নতুন শব্দ যোগ করা হয়, যা বর্তমান রাশিয়ার মূল্যবোধ এবং ঐতিহ্যকে প্রতিফলিত করে।

আমরা যদি আমাদের জাতীয় সঙ্গীতে দেশের গৌরবময় ইতিহাস এবং সংগ্রামের প্রতিফলন চাই, তবে এর পরিবর্তন বা সম্পূরক একটি জাতীয় সঙ্গীতের প্রবর্তন প্রয়োজন। এতে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, এবং স্বাধীনতার গৌরবময় ইতিহাস স্থান পাবে। এটি আমাদের নতুন প্রজন্মকে তাদের ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের সুযোগ করে দেবে এবং জাতীয় চেতনা আরও সুদৃঢ় করবে। “আমার সোনার বাংলা” আমাদের জাতীয় চেতনার একটি অমূল্য অংশ, তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে এর প্রয়োজনীয়তা পুনর্বিবেচনা করার সময় এসেছে। ইতিহাসের গভীর বিশ্লেষণের ভিত্তিতে, আমাদের জাতীয় সঙ্গীতে দেশের সংগ্রাম, ভাষা, সংস্কৃতি এবং স্বাধীনতার প্রতিফলন থাকা জরুরি। জাতীয় সঙ্গীতের পরিবর্তন একটি সাহসী পদক্ষেপ হলেও, এটি একটি প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হতে পারে, যা আমাদের জাতির পরিচয়কে আরও শক্তিশালী করে তুলবে।

লেখক: সৈয়দ আতিকুর রব, আয়ারল্যান্ড প্রবাসী।