ডাকসু নির্বাচন ঘিরে তৈরি হচ্ছে সংঘাতের আশঙ্কা

- আপডেট সময় : ১০:৩৪:৩৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৭ জানুয়ারী ২০২৫ ২১ বার পঠিত
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গঠিত হওয়া অন্তর্বর্তী সরকার ইতিমধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের একটি সময়সীমা উল্লেখ করেছে। এরই মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনেরও প্রস্তুতি নিচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তবে জাতীয় নির্বাচনের আগের সময়ে ডাকসু নির্বাচন আয়োজন করলে তাতে ক্যাম্পাসে সংঘাতের আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ক্যাম্পাসের ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনের বেশির ভাগ জাতীয় নির্বাচনের আগে ছাত্র সংসদের নির্বাচনের ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছে। এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গণঅভ্যুত্থানে সৃষ্ট সব ছাত্রসংগঠনের ঐক্যও বিনষ্ট হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এতে করে ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশ বিঘ্ন হওয়াসহ জাতীয় রাজনীতিতেও এর দীর্ঘমেয়াদি খারাপ প্রভাব পড়তে পারে।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এবং ছাত্রসংগঠনগুলোর সঙ্গে কথা বলেও ডাকসু নির্বাচন ইস্যুতে তাদের মধ্যে ভিন্নমত দেখা গেছে। নির্বাচন নিয়ে স্পষ্ট মতপার্থক্য দেখা গেছে বিভিন্ন বড় ছাত্রসংগঠনের মধ্যে। প্রক্রিয়া, সম্ভাব্য সংস্কার ও নির্বাচনের সময় নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত দিয়েছে ছাত্রসংগঠনগুলো। এ নিয়ে বিরোধ, পালটাপালটি বক্তব্য, প্রতিবাদ মিছিলে সরগরম হয়ে উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। কোনো পক্ষ দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বললেও অন্য পক্ষ যাবতীয় সংস্কার ও উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতের পরই নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রক্রিয়ার পক্ষে।
ডাকসু নির্বাচন ইস্যুতে গত সপ্তাহে পরিস্থিতি হঠাত্ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটে আওয়ামীপন্থি সদস্যদের আধিক্য এবং তাদের নিয়ে সিন্ডিকেট মিটিং শুরু হওয়াতে ছাত্রদলসহ সাধারণ শিক্ষার্থীরা সিনেট ভবনে উপস্থিত হয়ে প্রতিবাদ জানান। সেদিন সাধারণ শিক্ষার্থীসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্ল্যাটফরমের অনেক সমন্বয়ক অভিযোগ করেন, সিন্ডিকেটের মিটিংয়ে ছাত্রদল ডাকসু নির্বাচন পেছানোর জন্য উপাচার্য ও প্রক্টরকে হেনস্তা করেছে।
যদিও প্রশাসন ও ছাত্রদল বলছে, হেনস্তার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি। তবে এই ঘটনায় মধ্যরাতেই ক্যাম্পাসে একটি প্রতিবাদ মিছিল ও বিক্ষোভ সমাবেশ করে শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী সাকিব আহমেদ বলেন, গণতান্ত্রিক ডাকসুর যারা বিরোধিতা করেন, তাদের জায়গা এই ক্যাম্পাসে হবে না। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক মাহিন সরকারও সেই সমাবেশে ডাকসু নিয়ে বিরোধিতার প্রতিবাদ জানিয়ে দ্রুত রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিথ্যাচারের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে গণমাধ্যমে বিবৃতিও দেয়।
সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় স্পষ্টত, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দ্রুত ডাকসু নির্বাচন চাইলেও জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলসহ কয়েকটি সংগঠন নির্বাচনের আগে ডাকসুর গঠনতন্ত্র সংস্কার, আওয়ামীপন্থি সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়াসহ প্রয়োজনীয় সংস্কার চাইছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ২০১৯ সালে ছাত্রদলের প্যানেলে ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে নির্বাচন করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সিনিয়র সহসভাপতি আনিসুর রহমান খন্দকার অনিক ইত্তেফাককে বলেন, গত ডাকসুতে ছাত্রদলকে হারানোর জন্য আওয়ামীপন্থি সিন্ডিকেট অবৈধ এবং অগণতান্ত্রিকভাবে ডাকসুর গঠনতন্ত্র পরিবর্তন করেছিল। স্বৈরাচার সরকারের পতন হলেও এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটে আওয়ামী দোসরদের একচ্ছত্র আধিপত্য। এমন পরিস্থিতিতে ২০১৯ সালের গঠনতন্ত্র এবং আওয়ামী লীগের মনোনীত সিন্ডিকেট সদস্যদের বহাল রেখে ডাকসু নির্বাচন হতে দেওয়া জুলাই আন্দোলনকে বিতর্কিত করার শামিল হবে।
অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং শিক্ষার্থীদের একটা অংশ মনে করছে, ক্যাম্পাসগুলোতে লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার জন্য একটা পক্ষ ডাকসুসহ ছাত্রসংসদ নির্বাচনগুলো বিলম্বিত করতে চাইছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার এ বিষয়ে বলেন, ‘স্বৈরাচারের আমলে ভোটচুরির একটা ডাকসু হয়েছে। সেসময় সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের সত্যিকারের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারেনি। এখন ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থানের পর নতুন বাংলাদেশে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে চায়। এই সময়ে এসে সারা দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে অবিলম্বে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতে হবে। সব ধরনের লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি থেকে ছাত্রদের রক্ষা করতে হলে ডাকসুর বিকল্প নেই। যারা ডাকসু নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতে চায়, তারা আসলে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে লেজুড়বৃত্তির দাসত্ব কায়েম রাখতে চায়।’
ডাকসু নির্বাচন ইস্যুতে ছাত্রদের বড় অংশের এমন পরস্পরবিরোধী অবস্থান ক্যাম্পাসে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বিঘ্ন করতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক ইত্তেফাককে বলেন, “নিয়মতান্ত্রিকভাবে যদি ডাকসু হতো, তাহলে এখন এত উত্তাপ বা উত্তেজনা তৈরি হতো না। আগে আমরা দেখেছি যারা ডাকসুতে নেতৃত্বে আসে, তারা ‘ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণে’ চায়। এই সুযোগটা কেউই মিস করতে চায় না।”
তিনি মনে করেন, অভ্যুত্থানে শিক্ষার্থীদের সব পক্ষ এক হয়ে কাজ করলেও ডাকসুকে সামনে রেখে পারস্পরিক সহযোগিতাটা থাকবে না—এটাই স্বাভাবিক। এ অবস্থায় সব পক্ষের প্রত্যাশাগুলোকে ন্যূনতম ঐক্যে নিয়ে আসতে না পারলে সংঘাত, সহিংসতা তৈরি হতে পারে, যা দীর্ঘ মেয়াদে অগণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করবে।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানুয়ারির শেষ সপ্তাহ কিংবা ফেব্রুয়ারির প্রথমে ডাকসু নির্বাচন আয়োজনের ইচ্ছার কথা জানালেও এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনো রোডম্যাপ দেয়নি। ঢাবি উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান সম্প্রতি গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘ডাকসু আমাদের অঙ্গীকার। ডাকসুর জন্য একটি কমিটি গঠন করে দিয়েছি। কমিটি সব অংশীজনের সঙ্গে কথা বলে সুপারিশ জমা দেবে। সেই সুপারিশের আলোকেই ডাকসু নির্বাচন আয়োজন করবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা কাম্য।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপউপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা ইত্তেফাককে বলেন, ডাকসু নিয়ে এখনো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলে সবাইকে জানানো হবে।
তিনি জানান, ‘ছাত্রসংগঠনগুলোর দাবির প্রেক্ষিতে আমাদের দুটো কমিটি কাজ করছে। একটি কমিটি সব অংশীজনের সঙ্গে বসে আলাপ-আলোচনা করছে। কিছুদিন আগে ডাকসুর গঠনতন্ত্র সংশোধনের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেই কমিটি ডাকসুর গঠনতন্ত্র সংশোধনের বিষয়ে কাজ করছে। সবার মতামতকে গুরুত্ব দিয়েই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’