বৈষম্যের অন্ধকারে নিমজ্জিত প্রকৌশল শিক্ষার আরেক জগত: ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ
- আপডেট সময় : ০৪:০০:১১ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪ ২২ বার পঠিত
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে বিশেষায়িত কলেজগুলোই সবচেয়ে বেশি সমস্যা, জটিলতা কিংবা বৈষম্যের শিকার হয়; যা ইতোপূর্বে দেখেছে এদেশের মানুষ। এসব কারণেই বছরের পর বছর বৈষম্যের শিকার হয়ে বিভিন্ন বিশেষায়িত কলেজগুলো পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর হয়েছে। এরমধ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ নামক প্রতিষ্ঠানগুলোর সমস্যা তৈরির মূল কারিগর হলো শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগচ। এই অধিদপ্তরের অনিয়ম, দুর্নীতি ও পিছিয়ে রাখা মনোভাব বেশ পুরনো। তাদের অনিয়ম দূর্নীতির কারণেই বছরের পর বছর বৈষম্যের শিকার হয়ে অনেক আন্দোলন ও দাবীর পর বাংলাদেশের প্রাথমিক সময়ের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (পরবর্তীতে বিআইটি) গুলো আজকের রুয়েট, কুয়েট, চুয়েট, ডুয়েটে রূপান্তরিত হয়েছিল। এছাড়াও বাকী রূপান্তরিত বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানগুলোঃ বুটেক্স, পবিপ্রবি, সিকৃবি, হাবিপ্রবি, শেকৃবি, বশেমুরকৃবি। বর্তমানেও কারিগরি অধিদপ্তরের অধীনে রয়েছে সকল পলিটেকনিক, মনোটেকনিক ও বাংলাদেশের সরকারি ৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ।
১। ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ।
২। সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ।
৩। ফরিদপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ।
৪। বরিশাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ।
এবং
প্রস্তাবিত আরো ৪ টি। (১। নড়াইল, ২। ঠাকুরগাঁও, ৩। খাগড়াছড়ি, ৪। নওগাঁ) যেসকল জটিলতা, সমস্যার কারণে উক্ত ১৪ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত অথবা ফ্যাকাল্টিতে পরিণত করা হয়েছে, ঠিক সেই সমস্যার দুয়ার নতুন করে সৃষ্টি করা হয়েছে ৪ টি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ করে।
ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলো যেসকল সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যা না বললেই নয়:
১। ইউজিসি-র অভিন্ন শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালার আলোকে মানসম্মত শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যর্থতা। এই নিয়োগ নীতিমালা অনুযায়ী মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগে বাংলাদেশ কর্ম কমিশন ও কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রিতা।
২। ১৭ বছরেও এখন পর্যন্ত সেই মানসম্পন্ন অধিদপ্তরের অযোগ্যতার স্পষ্ট দৃষ্টান্ত। একজন স্থায়ী অধ্যক্ষ নিয়োগ দিতে পারেনি, যা কারিগরি শিক্ষা
৩। বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হওয়া সত্ত্বেও পর্যাপ্ত শিক্ষক না থাকা। গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এর বাইরেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সাত কলেজের প্রতিটি বিভাগে পর্যাপ্ত অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক বিদ্যমান, সেখানে এইসকল প্রতিষ্ঠানগুলোতে BSC in Engineering পড়ানো সত্ত্বেও ৪টি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে মাত্র দুজন অধ্যাপক রয়েছেন। এমনকি দুটি কলেজের প্রতিষ্ঠান প্রধান হলেন সহকারী অধ্যাপক। এখানেই পরিলক্ষিত হচ্ছে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর নিয়োগ ব্যর্থতা।
৪। একটি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উচ্চতর ও গবেষণাধর্মী শিক্ষার পরিবেশ পরিপূর্ণভাবে নিশ্চিত করতে যেই ধরণের প্রাতিষ্ঠানিক আয়তন দরকার, সেই অনুযায়ী যথেষ্ঠ ভূমি এই সকল প্রতিষ্ঠানগুলোতে নেই। এজন্য বারংবার দাবী জানিয়ে আসলেও প্রতিষ্ঠার এত বছরেও কলেজের জন্য নতুন করে ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে কোনো প্রকার উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেনি। এক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের উদাসীনতা স্পষ্ট।
৫। বিভাগ সংখ্যা বৃদ্ধি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত উন্নয়নে সম্পূর্ণ রূপে ব্যর্থ কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর।
৬। শহর এবং হাসপাতাল দূরে অবস্থিত হওয়া সত্ত্বেও কোনো পরিবহন ব্যবস্থা ও এম্বুল্যান্স না থাকা এবং প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য কোনো মেডিকেল সেন্টার না থাকা।
৮। হাতে কলমে প্রকৌশল শিক্ষার জন্য ল্যাব ইকুইপমেন্ট এর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু প্রতিষ্ঠার এত বছর পরও পুরাতন সব ইকুইপমেন্ট দিয়েই ল্যাব করতে হয় যার অধিকাংশই বর্তমানে অকেজো। ফলে বিভাগগুলোতে পর্যাপ্ত আধুনিক ল্যাব ইকুইপমেন্ট না থাকায় এবং দক্ষ ও টেকনিক্যাল ক্রাফট ইনস্ট্রাক্টরের নিয়োগে জটিলতার কারণে হাতে কলমে মানসম্পন্ন শিক্ষা থেকে পিছিয়ে থাকা।
৯। ১৭ বছরে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প না নেয়া। যেমন: পর্যাপ্ত সীট নিশ্চিত করতে আবাসিক হল ও হলের Accommodation বৃদ্ধি, ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে মসজিদ নির্মাণ ও খেলার মাঠ না থাকা, অডিটোরিয়াম, ব্যাংক এবং ডাকঘর নির্মাণ না করা।
১০। প্রকৌশল শিক্ষা মানেই গবেষণাধর্মী শিক্ষা। এরজন্য গবেষণা উপযোগী যেই ধরণের পরিবেশ এবং অর্থের যোগান দেয়া দরকার, গবেষণার জন্য সেই অর্থের ন্যূনতম যোগান দিতেও ব্যর্থ কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর, যা গুণগত উচ্চশিক্ষা অর্জনের প্রধান অন্তরায়। ফলে উচ্চতর শিক্ষা ও চাকুরির বাজারে বুয়েট, কুয়েট, চুয়েট, রুয়েট, ডুয়েট এর শিক্ষার্থীদের সাথে সমানতালে প্রতিযোগিতা হলেও শিক্ষা ও গবেষণার সুবিধার দিক থেকে যোজন যোজন পিছিয়ে রাখা।
১১। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের সমন্বয়হীনতার কারণে কয়েকবার চেষ্টা করেও IEB কর্তৃক স্বীকৃতি না পাওয়া। এবং IEB এর সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী, এসকল প্রতিষ্ঠানের ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষক নিয়োগ/ ফ্যাকাল্টি মেম্বার নিয়োগের কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো IEB কর্তৃক স্বীকৃতির মিনিমাম যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের অবহেলা স্পষ্টত। ফলশ্রুতিতে বুয়েট সহ বাকী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মত একই সিলেবাসে পড়াশোনা করে BSC ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রাজুয়েট হয়েও ইঞ্জিনিয়ার পদবী ব্যবহার ও ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পরিচয় দিতে না পারা এবং IEB স্বীকৃত রিকুয়ারমেন্ট চাওয়া চাকুরীর জন্য আবেদন করতে না পারা। যেখানে ছোট পরিসরে গড়ে উঠা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েও ওউই স্বীকৃতি থাকায় সম্মানের সাথে ইঞ্জিনিয়ার পদবী ব্যবহার করতে পারে। এই কারণে চাকুরীর বাজারে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরা ২য় শ্রেণীর গ্র্যাজুয়েট হিসেবে অবহেলার শিকার হচ্ছে।
১২। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর অধিভুক্তি নামক চরম অবহেলার শিকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু ভর্তি বাণিজ্য, প্রতি সেমিস্টারে ভর্তি ও পরিক্ষা ফি নিয়ে এবং সার্টিফিকেট দিয়েই দায়িত্ব শেষ। শিক্ষার মান উন্নয়ন নিয়ে কোনো দায়িত্ব পালন না করলেও সেশনজট তৈরি করা ৬ মাসের সেমিস্টার পরীক্ষা ৯ মাস সময়ে নেয়ার জন্য দায়ী। পরীক্ষার তারিখ সময়মতো নির্ধারণ না করার কারণে সেশনজট তৈরি হয়।
১৩। সেমিস্টার রেজাল্ট নিয়ে বিরাট গড়িমসি। প্রতি সেমিস্টারের রেজাল্ট দেয়া হয় পরবর্তী সেমিস্টার পরীক্ষা চলে আসলে। কোনো ছাত্র কোনো কারণে রেজাল্ট খারাপ করে ইয়ারড্রপ পেয়েছে সেটা জানতে পারে ইয়ারড্রপ পরীক্ষা শুরু হওয়ার ১০-১৫ দিন আগে। এবং ফাইনাল সেমিস্টারের রেজাল্ট প্রকাশ করতে কয়েক মাস ব্যয় করার কারণে অনেক শিক্ষার্থী বিভিন্ন চাকুরীর পরীক্ষায় আবেদন করতে পারেনা, ফলে চাকুরীর প্রতিযোগিতায় আরও পিছিয়ে যায়, যেখানে আমাদের দেশে সরকারি চাকুরীর বয়সসীমা নির্দিষ্ট, সেখানে রেজাল্ট অবহেলায় ১ বছর পিছিয়ে যাওয়ার ক্ষতি নিশ্চয় বলা বাহুল্য।
১৪। পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে অব্যবস্থাপনা থাকায় অনেক শিক্ষার্থীদের রেজাল্টের মান প্রতিফলিত হয় না।
১৫। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণহারে অধিভুক্তের নামে যেই বাণিজ্য চলমান রেখেছে, এর ফলে সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষার্থীরা সামাজিক হেয়পন্ন হচ্ছে। কারণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রযুক্তি ইউনিটে ভর্তি সমন্বয়ক রূপে ক্ষমতা প্রদর্শন করে বেশ কিছু অবৈধ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যুক্ত করেছে, যেগুলোর কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর ও শিক্ষা মন্ত্রনালয় কোনোটিরই কোনো অনুমোদন নেই। যার কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোর সমন্বয়হীনতা অভাব দিন দিন বেড়েই চলছে। এর সমাধান করতে হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্তি বাতিল করে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করার বিকল্প নেই।
সমস্যা, সংকট ও বৈষম্য নিরসনের এই দাবী আজকের নতুন নয় প্রতিষ্ঠার পর প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের কথা থাকলেও ভিন্ন সরকারের আমলে প্রতিষ্ঠা হওয়ায় শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে এই ২ টি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হয়নি। এমনকি কারিগরি অধিদপ্তরের ইচ্ছাকৃত অবহেলার কারণে সৃষ্ট এইসকল সমস্যা, সংকট ও বৈষম্য নিরসনের জন্য ৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের মধ্যে সিলেট ও ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ২০১৪, ১৫, ১৭, ১৮, ২০, ২৩ সাল সহ দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করার আন্দোলন ও দাবী জানিয়ে আসছে। এমনকি সর্বশেষ ২০২৩, ২০১৩, ২০১৮ সালে একাধিকবার জনগণের দাবীর মুখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিলেট ও ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত করার কথা বলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করেনি।
কারিগরি অধিদপ্তরের অযোগ্যতা এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ সমস্যা আজকের নতুন কিছু নয়। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার নানাবিদ জটিল, ব্যাপক ও গুরুতর সমস্যা নিরসনের জন্য ১৯৭৪ সালের মে মাসে প্রকাশিত -বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট- মুহাম্মদ কুদরত-ই-খুদা’- এর ১৪নং অধ্যায়ে ১০৪নং পৃষ্ঠায় “ও” নং অনুচ্ছেদে তৎকালীন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ সমূহের সমস্যা নিরসন ও কারিগরি অধিদপ্তরের অযোগ্যতার সমাধান প্রসঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে, ‘প্রকৌশল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষার মান উন্নীত করার জন্য আশু ব্যবস্থা অবলম্বন করা প্রয়োজন। প্রকৌশল কলেজগুলিতে সাজসরঞ্জাম এবং উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব রয়েছে। বর্তমান প্রশাসনিক ব্যবস্থায় শিক্ষক ও অন্যান্য কর্মচারী নিয়োগ, সাজসরঞ্জাম ক্রয় ইত্যাদি ব্যাপারে কলেজগুলি বিশেষ অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে। তাই আমরা মনে করি যে, এ কলেজগুলিকে সহায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা দরকার।
একই দাবী একই অধ্যায়ে ১০৭নং পৃষ্ঠার ৭ম পয়েন্টে বলা হয়েছে প্রকৌশল কলেজগুলি এবং কারিগরি শিক্ষক-শিক্ষণ কলেজের ব্যবস্থাপনা এবং শিক্ষার মান উন্নীত করা একান্ত প্রয়োজন। এ উদ্দেশ্যে কলেজগুলিকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা দরকার।
অথচ আজ থেকে ৫০ বছর আগেই তৎকালীন শিক্ষানুরাগী শিক্ষাবিদগণ এইসব প্রতিষ্ঠানের মূল সমস্যা ও যেই সমাধান তুলে ধরেছিলেন, সেই একই সমস্যায় জর্জরিত হয়ে আছে বর্তমান ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলো। কিন্তু তৎকালীন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোর ক্ষেত্রে বিকল্প সমাধানের বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্ট প্রয়োগ করে সবশেষে সেই একমাত্র সমাধান তথা বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর এর মাধ্যমেই নিরসন হয়েছে। কিন্তু ৫০ বছর আগেই সমাধানের রূপরেখা দেয়া হলেও, আজ এতবছর পর একই সমস্যায় জর্জরিত থাকা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলোর ব্যাপারে চিন্তা চেতনায় সেই ৫০ বছর আগের শিক্ষাবিদদের থেকেও পিছিয়ে আছি। তাই চোখের সামনে দৃষ্টান্ত থাকা সত্বেও আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলো আজও পর্যন্ত নানা টালবাহানার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় হয়নি, কারিগরি অধিদপ্তরের এই অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে বের হতে পারেনি।
এতকিছুর পরও পিছিয়ে রাখা এই শিক্ষার্থীদের সাফল্যঃ
১. বাংলাদেশের মাটিতে প্রথম রকেট “Dhumketu-X” ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এর শিক্ষার্থীদের তৈরি। উক্ত ক্যাম্পাসের আলফা সায়েন্স ল্যাব’-এ নাহিয়ান আল রহমান সহ উক্ত কলেজের শিক্ষার্থীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে তৈরি।
২.) এসকল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলো হতে প্রতিবছর অনেক শিক্ষার্থী সহ এযাবৎ শতাধিক শিক্ষার্থী বৃত্তি (ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপ) নিয়ে বিদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য গমন করছে।
৩.) গবেষণার ন্যূনতম সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হওয়া সত্বেও এসকল প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিবছর অনেক শিক্ষার্থী নিজেদের প্রচেষ্টায় গবেষণাপত্র আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জার্নালে এবং কনফারেন্সে প্রকাশ করছে।
৪.) বিভিন্ন সময়ে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত কনটেস্টে সফলতার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভারতের IIT তে আয়োজিত TechFest এর Robo Wars এ ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এর টিম বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে সফলতা ও যোগ্যতা প্রমান করেছে।
৫.) সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে গ্রাজুয়েট হয়ে Apple এর সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগদান। এবং মালয়েশিয়ার ই-বাইক কোম্পানিতে হার্ডওয়ার সেকশনের লিড ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগদান।
৬.) সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এর শিক্ষার্থীরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট কনটেস্ট এ প্রথম স্থান অর্জন: আইসিপিসি এশিয়া-ওয়েস্ট কন্টিনেন্ট এ ৩৯ তম স্থান অর্জন: COU-BRACNET ইউনিভার্সিটি প্রোগ্রামিং কন্টেস্ট ২০২৩ এ ১৫ তম স্থান অর্জন এবং একই বছর আইসিপিসি এশিয়া ঢাকা রিজিওনাল কনটেস্টে ৩৮ তম স্থান অর্জন।
৭.) বিসিএস সহ সরকারি ও বেসরকারি চাকুরীর প্রায় সকল সেক্টরে এসব কলেজের শিক্ষার্থীরা সুনামের সাথে চাকুরীরত আছে।
এই ৪ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বুয়েটের মত একই শিক্ষা কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত হলেও, একই সিলেবাসে পড়াশোনা করে BSc ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রী নেয়; কিন্তু কোনোদিক দিয়েই সুযোগ-সুবিধা পায় না তাদের ধারেকাছেও।
বৈষম্যের শিকার হয়ে আছে কারিগরি অধিদপ্তরের অধীনে থাকার কারণে। পর্যাপ্ত শিক্ষক না থাকায় পড়াশোনা ও মানসম্মত ল্যাব সুবিধা পাওয়া যায় না তাদের মতো। বুয়েট, কুয়েট, চুয়েট, রুয়েট, ডুয়েট গবেষণা খাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে টাকা বরাদ্দ পায়। অথচ এইসব কলেজগুলো তে শিক্ষার্থীরা গবেষণা খাতে ন্যূনতম টাকাও পায়না। এভাবে গবেষণা খাতে কোনো সহোযোগিতা না পেয়েও এতসব উদ্ভাবনী কাজগুলো কিভাবে করছে? সম্পূর্ণ নিজেদের উদ্যোগে। তবুও এইসব কলেজের শিক্ষার্থীদের নিজেদের প্রচেষ্টায় এসব সফলতাগুলো কি তাদের দমিয়ে রাখা মেধা আর ইচ্ছা শক্তির সাক্ষ্য দেয় না? তাহলে স্পষ্টভাবেই বুঝা যায় যে, বিশ্ববিদ্যালইয়ে রূপান্তর হলে এইসব সমস্যা স্থায়ীভাবে নিরসন হবে এবং এই মেধাবী ছাত্রগুলো গবেষণার সুযোগ পেলে দেশের জন্য কাজ করার সুযোগ পাবে।
বিশ্ববিদ্যালয় রূপান্তর ব্যতীত মধ্যপন্থা কিছু কি সমাধান হতে পারে? তাহলে জানতে হবে চুয়েট, কুয়েট, রুয়েট, ডুয়েট কেন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে BIT এর পথ পারি দিয়ে সবশেষে আজ পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়? এ যেন অবনমণের পথে পদার্পন: প্রকৌশল মহাবিদ্যালয় থেকে বি.আই.টি তে রূপান্তরের ফলে সীমিত পরিসরে স্বায়ত্বশাসন লাভ করলেও বিভিন্ন প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতা বিআইটি চট্টগ্রামকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছিল। BUET এর মত একই শিক্ষা কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত হলেও বিআইটি থেকে পাশ করা মেধাবী শিক্ষার্থীরা দেশে বিদেশে ডিগ্রীর স্বীকৃতির বিষয়ে অনাকাঙ্খিত সমস্যার সম্মুখীন হতে থাকে। বিআইটিগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর না করার ফলে নানা সমস্যা দিন দিন বাড়তে থাকে এবং কিছু কিছু সমস্যা স্থায়ীত্বের রূপ নেয়।
উল্লেখযোগ্য কিছু সমস্যার মধ্যে ছিল প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার্থী সংখ্যা বৃদ্ধি না করা, নতুন নতুন বিভাগ ও গবেষণা কেন্দ্র না খোলা, পদ সৃষ্টির অভাবে শিক্ষক স্বল্পতা ও উচ্চতর ডিগ্রীপ্রাপ্ত যোগ্য শিক্ষকদের পদোন্নতি না দেওয়া এবং লোকবলের অভাব, কম বাজেট বরাদ্দ, শিক্ষার উপকরণ স্বল্পতা, গবেষণাগারের আধুনিকায়ন না করা, স্নাতোকোত্তর ও গবেষণা কার্যক্রমের স্থবিরতা, নিজস্ব চাকুরি বিধি না থাকা, নানাবিধ প্রশাসনিক ও একাডেমিক জটিলতা ইত্যাদি। এভাবে BIT এর ব্যর্থতা, সমস্যা নিরসনে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের জন্য ২০০১ অবধি দফায় দফায় সভা, সমাবেশ, আন্দোলন চলতে থাকে। এরূপ অবস্থার কারণে বলা হয়েছিলো- যখন Engineering College ছিল তখন নিজেদেরকে 2nd Category-র মনে হত; কারণ, convocation হত CU তে। তখন সাধারণ পাসকোর্সে স্নাতক ডিগ্রী প্রাপ্তদের কাতারে বসতে দেয়া হত আমাদের। কিন্তু BIT হওয়ার পর মনে হয় আমরা এখন 3rd Category তে নেমে গিয়েছি। দীর্ঘ সময় এর মধ্যে বিভিন্ন মহল থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের মন্ত্রী পর্যায়ের লোক থেকে শুরু করে সরকারি আমলা নানা আশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি দিয়েও আশানুরূপ ফল না পাওয়ায় আন্দোলন টানা চলমান থাকে। চারটি বিআইটিকে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের ঘোষণা দেন। এবং ১লা সেপ্টেম্বর ২০০৩ থেকে পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করে বর্তমান এর ফলশ্রুতিতে অবশেষে ২০০২ সালের ১০ই মার্চ ঢাকাস্থ CUET, KUET, RUET, DUET