রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশ করতে পারবে ট্রাইব্যুনাল

- আপডেট সময় : ১০:৩৮:০৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪ ২৯ বার পঠিত
গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন সংশোধনের খসড়া উঠছে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে। ঐ খসড়ায় অপরাধ সংঘটনের দায়ে রাজনৈতিক দলকে সরাসরি শাস্তি প্রদানের ক্ষমতা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে দেওয়া হচ্ছে না। তবে ট্রাইব্যুনাল চাইলে প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ করতে পারবেন।
মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নের জবাবে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।
তিনি বলেন, খসড়া প্রস্তাবে যেটি আছে, সেখানে আদালতকে সেভাবে সরাসরি ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। বলা হয়েছে, আদালত যদি মনে করে, তাহলে প্রয়োজনীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য তারা সুপারিশ করতে পারবে।
আইন উপদেষ্টা বলেন, এখানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ হতে পারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিংবা নির্বাচন কমিশন। অবশ্য এগুলোর কথা খসড়ায় উল্লেখ করা নেই। এটা এমন নয় যে আদালত শাস্তি দেবেই। আদালত যদি মনে করে, শাস্তি দেওয়ার সুপারিশ করবে শুধু। এটা খসড়ায় রাখা হয়েছে। তবে এটি উপদেষ্টা পরিষদের ওপর নির্ভর করে, পরিষদ এটি রাখবে কি না, বা কী ফরমে রাখবে। এ বিষয়ে একটি দিন অপেক্ষা করেন, দেখবেন। সংশোধনী তো উপদেষ্টা পরিষদকে গ্রহণ করতে হবে।
তিনি বলেন, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে এবং গত জুলাই-আগস্ট মাসে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নিশ্চিতের লক্ষ্যে রোম স্ট্যাটিউট এবং আন্তর্জাতিক ও জাতীয় বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের সুপারিশের আলোকে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এর সংশোধনের খসড়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। অধ্যাদেশটি পাশ হলে সে অনুযায়ী কার্যক্রম শুরু হবে।
‘অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন: আইন মন্ত্রণালয়ের কৈফিয়ত’ শীর্ষক এই সংবাদ সম্মেলনে আইন মন্ত্রণালয়ের বিগত ১০০ দিনের কর্মকাণ্ড তুলে ধরেন আইন উপদেষ্টা। নির্বাচন প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি আইন মন্ত্রণালয়ের বিষয় নয়। তবে একটি বিষয় বলি, আমরা মোস্ট অ্যাসেনশিয়াল (অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ) কিছু সংস্কার করে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দেব। আমরা জাস্ট এই জিনিসটা চাই না যে আগের মতো কোনো ভুয়া নির্বাচন হোক। আর এটাও চাই না নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে কেউ আবার ভুয়া নির্বাচন করার সুযোগ পাক। এটা ছাড়া আর কোনো স্বার্থ নাই। অন্তর্বর্তী সরকারে যারা আছেন, তাদের অধিকাংশই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজের পেশায় ফিরে যেতে আগ্রহী।
গণআন্দোলন দমনের প্রায় সব মামলা প্রত্যাহার
আইন উপদেষ্টা বলেন, গত পহেলা জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার গণআন্দোলন দমনে দায়ের করা প্রায় সব ফৌজদারি মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিলক্রমে কম্পিউটার সম্পর্কিত অপরাধগুলো প্রতিরোধের জন্য তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে নতুন সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ প্রণয়নের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। সাইবার নিরাপত্তা আইন রহিত হলে এই আইনের অধীনে দায়ের করা সব স্পিচ-অফেন্সের মামলা প্রত্যাহার করা হবে। অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শ করে এই আইন প্রত্যাহারে আমরা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়কে সহায়তা করেছি। তবে হ্যাকিং বা কম্পিউটার অপরাধসংক্রান্ত মামলাগুলো চলমান থাকবে বলে তিনি জানান।
পালানোর তিন দিন আগেই স্বজনদের বিদেশে পাঠান শেখ হাসিনা
আইন উপদেষ্টা বলেন, শেখ হাসিনা নেতাকর্মীদের ফেলে রেখে নিজে পালিয়েছেন। নিজে পালানোর তিন দিন আগে তার স্বজনদের বিদেশে পাঠিয়েছেন। নেতাকর্মীদের তাকে প্রশ্ন করা উচিত, তাদের ফেলে রেখে কেন পালিয়েছেন তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শেখ হাসিনাকে ফেরাতে ট্রাইব্যুনালের মতামতের ভিত্তিতে বন্দি বিনিময় চুক্তির আওতায় তাকে চাইব। মামলার যে কোনো পর্যায়ে যে কোনো বন্দিকে ফেরানোর জন্য অনুরোধ করা যাবে। দেশে কোনো আসামিকে না পেলে রেড এলার্ট জারির আবেদন করতেই পারি। বাংলাদেশ ইন্টাপোলের সদস্য।
আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকার আওয়ামী লীগের মতো দমনপীড়ন চায় না। অযৌক্তিক আন্দোলনের মাধ্যমে নানা দুর্ভোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে। সরকার বিষয়গুলো দেখছে। কঠোর হলে সরকার ভালোভাবেই কঠোর হবে।
সংস্কার কমিশনকে সাচিবিক সহায়তা
আইন উপদেষ্টা বলেন, গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদ অনুসমর্থনে আইন মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করেছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান ও গুমে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়নের নিমিত্তে তদন্ত কমিশন গঠনে আইন ও বিচার বিভাগ প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করেছে। কমিশনকেও আইন মন্ত্রণালয় সাচিবিক সহায়তাও প্রদান করে যাচ্ছে। তাছাড়া স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও কার্যকর বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়েছে। সংস্কার কমিশন গত ১২ নভেম্বর আমার সঙ্গে বৈঠক করেছে। আশা করছি, কমিশন বিচার বিভাগের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ সংস্কার প্রস্তাব দ্রুতই প্রস্তুত করবে। সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট পাওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করা হবে।
মিথ্যা মামলা বন্ধে আইন করার চেষ্টা
আসিফ নজরুল বলেন, একবার সিদ্ধান্ত নিলাম সিআরপিসি পরিবর্তন করে পুলিশকে ক্ষমতা দেওয়া হোক, উনারা এফআইআর করার আগে তদন্ত করবেন। তখন বিভিন্ন পক্ষ থেকে বলা হলো-এটা করা হলে পুলিশকে দুবার স্বেচ্ছাচারিতা করার সুযোগ দেওয়া হবে। যদি পুলিশ হয়রানি করে। এখন যেটা চিন্তা করছি এসপি, ডিসি, জেলা লিগ্যাল এইড কর্মকর্তাদের নিয়ে কোনো কমিটি করা যায় কি না। এফআইআর করার আগে এই কমিটি যাচাই-বাছাই করে দেবে। এটা আমাদের করতে হবে, কারণ আজ যারা হয়রানি, মিথ্যা ও বাণিজ্যমূলক মামলা করছেন। কাউকে কাউকে নাকি থ্রেটও দেওয়া হচ্ছে টাকা না দিলে মামলা করবেন। আপনারা শুধু মনে রাখবেন, আমি যদি এই মন্ত্রণালয়ে থাকি আপনাদের (মিথ্যা মামলা করা ব্যক্তি) কীভাবে শাস্তি দেওয়া যায় সেটার আইন আমি খুঁজে বের করব।
আইন উপদেষ্টা জানান, সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের বিচারপতি নিয়োগ আইনের খসড়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। আশা করছি, নতুন আইনের মাধ্যমেই পরবর্তী বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হবে। তিনি বলেন, অধস্তন আদালতের বিচারক, রেজিস্ট্রেশন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা এবং আইন মন্ত্রণালয় ও এর অধীন দপ্তর সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব সংগ্রহ করা হয়েছে। এই হিসাব বিবরণী এখন যাচাইবাছাই করা হচ্ছে। তিনি জানান, আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের মাধ্যমে বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনী (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪ এবং জাতির পিতার পরিবার-সদস্যগণের নিরাপত্তা (রহিতকরণ) অধ্যাদেশসহ মোট ১০টি অধ্যাদেশ প্রণয়নে ভেটিং সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ৯৫টি প্রজ্ঞাপন, ৩৩টি বৈদেশিক চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক ভেটিং করা হয়েছে।
আইন উপদেষ্টা বলেন, আমার অভিজ্ঞতার বা যোগ্যতারও হয়তো ঘাটতি আছে। কিন্তু বারবার একটা কথা বলি সেটা হলো, প্রচেষ্টার ঘাটতি নেই। কাজের জন্য ১০-এর মধ্যে খুব বেশি হলে নিজেকে ৪ নম্বর দেব। তবে আমার অতৃপ্তির অনেক জায়গা আছে। আমি কোনো দিনও সন্তুষ্ট নই আমার কাজে। সব সময় দোয়া করি আল্লাহর কাছে, আমাকে যে সুযোগ দিয়েছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান, আমি যেন সততা নিয়ে আরো কাজ করতে পারি।