সৈয়দ আবুল হোসেন : একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি
আলোচিত সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আবুল হোসেন ২৪ অক্টোবর রাত দুইটায় পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭২ বছর। তাঁর মৃত্যুতে যেন একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটলো। তিনি আমাদের মাঝে ইতিহাস হয়ে থাকবেন। এই ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে রইলাম আমি। মনে পড়ছে তার সান্নিধ্যে কাটানো সময়টুকুর কথা। তার অবদান যারা অস্বীকার করবেন; তারা হয়তো অকৃতজ্ঞ। নয়তো বিশ্বাসঘাতক। আমি অন্তত অস্বীকার করতে পারবো না।
সৈয়দ আবুল হোসেন মানে এলাকায় উৎসবের আমেজ। কৃষকের শরীরে সাদা গেঞ্জির বুকে-পিঠে তাঁর হাসিমাখা ছবি। ঘরে ঘরে সাকো ইন্টারন্যাশনালের ক্যালেন্ডার। প্রতিষ্ঠানের টেবিলে সৈয়দ আবুল হোসেনের দেওয়া ডায়েরি। তিনি নানাবিধ কাজে ব্যস্ত থাকতেন বলে কালকিনিতে আসতেন মাঝে মাঝে। তখন দেখেছি, সৈয়দ আবুল হোসেন মানেই জনতার উচ্ছ্বাস। সৈয়দ আবুল হোসেন মানেই এলাকার উন্নয়ন। সৈয়দ আবুল হোসেন মানেই শিক্ষায় নিবেদিত প্রাণ। সৈয়দ আবুল হোসেন মানেই কর্মীবান্ধব নেতা। তাঁর আগমনে রাস্তার দু’ধারে জনতার দীর্ঘ সারি থাকতো। নদীর দু’কূলে দাঁড়িয়ে থাকতো হাজারো মানুষ।
রাজনীতিতে সৈয়দ আবুল হোসেন অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। প্রতিপক্ষের প্রতি তার সহমর্মিতা, সহানুভূতি এবং দরদ দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। রাজনীতিতে সহাবস্থানে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি। বিরোধীদলকে অযথা হয়রানি করতেন না। এলাকায় শান্তি বজায় রাখার চেষ্টা করতেন। ‘কসাইখানা’ খ্যাত কালকিনিতে তিনি শান্তির বার্তা পৌঁছে দিয়েছিলেন। ছাত্রজীবনে সাংবাদিকতা করতে গিয়ে দেখেছি, তার বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশের পরও তিনি বিনয়ের সঙ্গে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো/ যুগ-জনমের বন্ধু সে যে আঁধার ঘরের আলো।’
ব্যক্তি সৈয়দ আবুল হোসেন অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ ছিলেন। তার ঢাকার বাসায় গিয়ে না খেয়ে কেউ যেতে পারেননি। তিনি গ্রামের বাড়ি ডাসারে গেলে অসংখ্য মানুষের দুপুর এবং রাতের খাবারের ব্যবস্থা করতেন। তিনি যতদিন বাড়িতে থাকতেন, ততদিন চলতো এমন। মনে হতো যেন একটা উৎসব। ২০১৪ সালে দলীয় নমিনেশন না পেয়ে অভিমান করেই হয়তো বাড়িতে তেমন আসতেন না। তারপরও যে কয়বার এসেছেন, হাসিমুখেই এসেছেন। জাঁকজমকভাবেই এসেছেন।
তিনি নবগঠিত উপজেলা ডাসারের যোগ্য সন্তান। তিনি অভিন্ন কালকিনি উপজেলার কৃতি সন্তান। শুধু তা-ই নয়, তিনি বাংলাদেশের নক্ষত্র ছিলেন। মাদারীপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। জীবদ্দশায় আমরা ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে তাঁকে লাঞ্ছিত করেছি। কিন্তু সেই লাঞ্ছনা ফিরে এসে আমাদের বিবেককেই বিদ্ধ করেছে। তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন। বিশ্ব ব্যাংকের আনিত অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মাসেতু উদ্বোধনের সময় তাকে সঙ্গে রেখেছেন। তাঁকে যথার্থ মূল্যায়ন করেছেন।
সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী। তাঁর মৃত্যুর সংবাদে মাদারীপুর জেলাজুড়ে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। এমনকি দেশজুড়েও আলোচিত হচ্ছে তাঁর নাম। তিনি অমর হয়ে রইলেন। রয়ে গেলেন মানুষের অন্তরে অন্তরে।
সৈয়দ আবুল হোসেন স্ত্রী খাজা নার্গিস, দুই মেয়ে সৈয়দা রুবাইয়াত হোসেন ও সৈয়দা ইফফাত হোসেনসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তিনি ১৯৫১ সালের ১ আগস্ট মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার ডাসার গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা মরহুম সৈয়দ আতাহার আলী এবং মা মরহুম সৈয়দা সুফিয়া আলী। তিনি ১৯৭২ সালে স্নাতক এবং ১৯৭৮ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে। পড়াশোনা শেষ করার পর আবুল হোসেন সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। পরবর্তীকালে চাকরি ছেড়ে ব্যবসা শুরু করেন। তিনি ১৯৭৫ সালে সাকো ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড এবং সাকো এনজিও প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি এশিয়ার বোয়াও ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন, যা ২০০১ সালে চিনের হাইনান প্রদেশে যাত্রা শুরু করেছিল।
সৈয়দ আবুল হোসেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হয়ে মাদারীপুর-৩ আসন থেকে ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেন। প্রথমবার নির্বাচনেই তিনি বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর আরও তিন মেয়াদে মাদারীপুর-৩ সংসদীয় এলাকার সংসদ সদস্য ছিলেন তিনি। ২০০৯ থেকে ২০১২ পর্যন্ত বাংলাদেশের যোগাযোগমন্ত্রী ছিলেন। এর আগে ১৯৯৬-৯৭ সালে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ছিলেন তিনি। তিনি সর্বশেষ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। এরপরে তিনি রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে শুরু করেন। দলীয় পদ আর গ্রহণ করেননি। ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংক অভিযোগ করে যে, পদ্মাসেতু গ্রাফট কেলেঙ্কারিতে সৈয়দ আবুল হোসেন একজন ষড়যন্ত্র —– পরববর্তী